কুষ্টিয়ার টোকাই, হকার, নেশাখোর সাংবাদিক ও সাংঘাতিকের গল্প!

লেখকঃ এডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
বহু বছর আগে কোন এক ছড়াকার রসিকতার ছলে ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে ভুয়া সাংবাদিকতার মুখোশ উন্মোচনে লিখেছিলেন-
‘‘হঠাৎ করে এই শহরে এলো যে এক সাংবাদিক কথায় কথায় তোলে ছবি ভাবখানা তার সাংঘাতিক।তিলকে সে বানায় তাল, তালকে আবার বানায় তিল
চড়ুইকে সে পেঁচা বানায়, কাককে বানায় চিল।চোদন দিলে মুখ লুকিয়ে পালায় দিগ্বিদিক লোকে বলে লোকটা নাকি টোকাই সাংবাদিক।
আমার দীর্ঘ তিন দশকের সাংবাদিকতার জীবনে ইদানিং কুষ্টিয়ায় দেখছি স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, পাতি নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যখন ত্রাণ বা কোন কিছু বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন তখন তারা ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে যে শারীরিক কসরত দেখান তা রীতিরকম বানরের আচরণের সাথে তুলনীয়। বানর যেমন লাফিয়ে গাছের এ ঢাল থেকে ওই ঢালে যায়, তেমনি এসকল টোকাই, মেথর, নেশাখোর, কথিত মাস্তান সাংবাদিক এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে বিভিন্ন স্টাইলে দু’ পাঁচ’শ টাকার বিনিময়ে কতো যে ছবি তুলেন বা ভিডিও করেন, তা নিজেও জানেনা।
মহাব্যস্ত এই সব কথিত সাংবাদিকরা মৌসুমগুলোতে ভালো টাকাও উপার্জন করেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন, পদত্যাগ করানো, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন দলের কর্মসূচিতে ছবি বা ভিডিও ফুটেজ নেওয়ার অঙ্গ-ভঙ্গিতে তাদের অনেকেই বানরের খেলা দেখিয়ে উপার্জন করে চলেছে।
কিন্তু, ওই ছবি কোন পত্রিকা বা অনলাইনে প্রকাশ কিংবা ভিডিও কোন টিভি চ্যানেলে প্রচার হয় তা শুধু ওই বানরগুলোই জানেন। তবে মাঝে মাঝে ছবির নিচে কিছু চমকপ্রদ কথা (বানান ও বাক্যে অসংখ্য ভুল) লিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে দিতেও পটু ওইসকল টোকাই সাংবাদিকেরা। এসব করে অনেকে আবার লুফে নিয়েছেন জায়গা-জমি, বাড়ি-গাড়ি। দিয়েছেন নিজের পরিবারের সদস্য আত্মীয়-জনসহ বিভিন্ন জনকে চাকুরি। দালালি করে উপার্জন করেছেন কোটি কোটি টাকা। বিশেষ করে সরকার পরিবর্তনের পর কুষ্টিয়ার সংঘবদ্ধ কথিত সাংবাদিক গং ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা বানিজ্য করেছে।
এদের দাপট আর আচরণে এখনো প্রকৃত সাংবাদিকরাই মুখ লুকিয়ে পালায়। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। পেশাদার সম্মানিত সাংবাদিকদের জন্য বিষয়টি লজ্জাকর হলেও ছড়া ছন্দের মতই ভূয়া সাংবাদি কুষ্টিয়া জুড়ে বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ফেলেছে। সাংবাদিক সেজেগুজে একশ্রেণির প্রতারক, টোকাই, নেশাখোর, স্থানীয় মাস্তান অফিস-আদালত, অলি-গলি চষে বেড়াচ্ছেন। পান থেকে চুন খসলেই রীতিমত বাহিনী নিয়ে হামলে পড়ছেন সেখানে। প্রকৃত ঘটনা কি-সে ঘটনার আদৌ কোনো নিউজ ভ্যালু আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার ফুসরৎ নেই তাদের। দরকার নিজেদের প্রতাপ দেখিয়ে, আতংক ছড়িয়ে টুপাইস কামিয়ে নেয়া। টোকাইদের অনেকে চার চাকার গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। জেলার বাইরে গেলে অনেকে চার চাকার গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যায়। কোনো ধান্ধা না হলে অবশেষে বলে তেলের খরচটা দিন।
আর কুষ্টিয়ার কথিত বড় বড় সাংবাদিক যারা বাড়ি, গাড়ি আর দালানের মালিক হয়েছেন, তাদের সারাদিন-সারা বছর দেখেছি, পুলিশ আর প্রশাসনের তোয়াজগিরি করতে। জনগণের বিপদাপদ ও মামলা-মোকদ্দমায় পক্ষপাতিত্ব বা পুলিশের সাথে খাতিরের সুযোগে দু’এক পয়সা হাতিয়ে নিতে। সরকারি টিআর-কাবিখা, কাবিটার প্রকল্প নিয়ে উদরপূর্তি করতে। সংবাদের নামে অর্থ হাতিয়ে নিতে। জনগুরুত্ব ও নির্যাতিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের সংবাদ অর্থের বিনিময়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে। অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, বালিমহল, নদী-পুকুর-খাল খননে পুকুর চুরি, দখলদারিত্ব আর টেন্ডারবাজির সংবাদ না করার বিনিময়ে পারিতোষিক নিতে। তারা পুলিশ আর প্রশাসনের সংবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ঘুর ঘুর করেন নেতা-পাতি নেতাদের পেছন পেছন নিউজ নিয়ে।
সেকারণ কুষ্টিয়ার সাংবাদিকরাই এখন সাংবাদিকের শক্র। চলছে ল্যাং মারার অসুস্থ-হীন মানসিক প্রতিযোগিতা। যদিও কিছু জাওড়ার পলায়নের মধ্যে দিয়ে জেলা জুড়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে।
সৎ ও সত্য সংবাদ লিখলে যেন সুবিধাবাদী সাংবাদিকদের আঁতে ঘা লাগে। সত্য লিখলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনপ্রেমি সাংবাদিকদের সম্মানে আঘাত হানে। রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসনের চেয়ে ওই সাংবাদিকদের যেন বেশি গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনে মনে ভাবে তাদের স্যারেরা যেন গোস্বা হয়ে গেল। তাদের কাছ থেকে হয়ত মুখ ফিরিয়ে নিল, ইজারার অর্থ যেন বেহাত হয়ে গেলো। এ জন্যই ভয়ে তটস্থ। সৎ ও সততার সাথে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অসৎ সাংবাদিকদের ল্যাং খাওয়ার ভয়ও তাড়া করে। কারণ সংবাদের চেয়ে অর্থের মোহে নিমজ্জিত থাকেন অসৎ সাংবাদিকরা। কথায় বলে, কাক কখনো ময়ূর হয় না। যতই লিখি না কেন অভ্যেস বদলানো কঠিন তাদের।
দেশে কত পত্রিকা রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কালভদ্রে বের হয়। তথাতথিত অনলাই পত্রিকা ও টেলিভিশনতো আছেই। কুষ্টিয়ায় এরকম পত্রিকা ও টেলিভিশন প্রতিনিধিদের বেশ দাপট। ব্যস্ত সাংবাদিক। পরিচয়পত্র আর টেলিভিশন হলে বুম (লেগো) ঝুলিয়ে ছুঁটে চলেন রানার! তাদের কত নামডাক। কোন ঘটন-অঘটন, নেতা, সভা-জনসভা, বিয়ে, মুসলমানি এমনকি ইসলামি জলসা ও ঈদ জামাতের ছবি তোলায় তাদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। আর নির্বাচন হলে তো কথাই নেই। তাদের ধারেন কাছে যায় কে।
সাংবাদিক না হয়েও সাংবাদিকতার বেশভূষা তাদের মূল পুঁজি। খ্যাত-অখ্যাত একাধিক গণমাধ্যমের ৪/৫টি আইডি কার্ড বুকে পিঠে ঝুলিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় সর্বত্র। যারা পেশাদার সাংবাদিক তাদের কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে সাইনবোর্ড হিসেবেও ব্যবহার করেন তারা। সম্ভব হলে সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনে নিজের নামটা লিখিয়ে নেয়, তা না হলে নিজেরাই ‘সাংবাদিক’ ‘রিপোর্টার’ ‘প্রেসক্লাব’ শব্দ যোগ করে ভূইফোঁড় কোনো সংগঠন খুলে বসেন। তখন তাদের বুলি থাকে অন্যরকম-“আমি সাংবাদিক কি না সেটা আপনার জানার দরকার নাই, আমি সাংবাদিকদের সেক্রেটারি বা প্রেসিডেন্ট। আমি সাংবাদিক বানাই, আমার স্বাক্ষরে আইডি কার্ড দেই- আমার পরিচয় আলাদাভাবে দেয়ার কি আছে?” ভূয়াদের এতোসব সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ও কথিত ক্লাব-ইউনিটি, ফোরাম, সোসাইটি, সংস্থা, সমিতি দাপ্তরিক প্রতারণার ধকলে নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এরা মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে ‘প্রেস’ কিংবা ‘সংবাদপত্র’ লিখে পুলিশের সামনে দিয়েই নির্বিঘেœ দাবড়ে বেড়ায়। এদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন যানবাহনও থাকে চোরাই এবং সম্পূর্ণ কাগজপত্রবিহীন। নামের আগে সাংবাদিক, জার্নালিস্ট লিখা থাকে। সাংবাদিকতা সম্পর্কে যাদের নূন্যতম জ্ঞানও নেই তাদের হাতে মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে আইডি কার্ড। যেনো অনুমতি দিয়ে অপসাংবাদিকতার লাইসেন্স দিয়েছে তাদের। কোনো কাজ নেই, লেখালেখি নেই, অন্যের লেখা ধার করে চলে। অনেকে পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবেও বিশ্বস্থ!
যদিও বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দীর্ঘদিন কলের গান শুনাচ্ছে। সাংবাদিক হতে হলে ¯œাতক ডিগ্রিধারী হতে হবে। অযোগ্য, অদক্ষ, টোকাই, হকার, নেশাখোর ব্যক্তিরা যাতে সাংবাদিকতা পেশায় আসতে না পারে এ জন্য রেজিস্ট্রিকৃত সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের তালিকাভুক্ত বা সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাটারাও বাটপার। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার।
কুষ্টিয়ায় সাংবাদিকতা এখন ‘হাস্যকর’ পেশা ‘বদনাম’। সাংবাদিকদের অনেকেই ব্যাঙ্গ করে বলেন ‘সাংঘাতিক’। একজন প্রকৃত সাংবাদিকের ‘সাংঘাতিক’ কথাটি শুনতে নিশ্চয়ই অনেক অপমান বোধ হয়। শুনতে অনেক কষ্ট লাগে। কিন্তু, প্রকৃত কোনো সাংবাদিকই এ কথাটির জোরালো প্রতিবাদ করেন না। কারণ, তারা মনে করেন, এ কথার যৌক্তিকতা আছে। তাই তারা হাসি মুখে কষ্ট করে হলেও কথাটি শুনে হজম করে ফেলেন। কারণ ‘সাংঘাতিক’ শব্দের অর্থ ভয়ানক; ভীষণ; মারাত্মক।
সংবাদ লেখা তো দূরের কথা নিজের নামটি সঠিকভাবে লিখতে বা বানান উচ্চারণ করতে না পারলেও অনেকেই এখন সাংবাদিক পরিচয় নেয়। নিজেকে বলেন ডিজিটাল সাংবাদিক। পড়া বা লিখার প্রয়োজন নেই। দেখতে ও অশুদ্ধ ভাষায় এটি সেটা বলতে পারলেই সাংবাদিক। অনেকে আবার সাংবাদিক শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারেন না। বলেন, সম্বাদিক। কেউ বলেন, সাম্বাদিক।
এখন শ্রমিক, নৈশ্য প্রহরী, হকার, দালাল, ভূমিখেকো, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, দেহব্যবসায়ী, টাউট, বাটপার কেউ বাকি নেই এ পেশায় পর্দাপনে।
কুষ্টিয়ার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা এখন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। জনমানুষ আস্থা হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন বলতে গেলে অস্তিত্ব সংকটে। বিষয়টি কথিত সিনিয়ররা ভেবে দেখবেন কী?
লেখকঃ ‘সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বিষয়ক’ পিএইচ. ডি গবেষক, দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি ‘দি ডেইলী অবজারভার’ এর সিনিয়র প্রতিনিধি ও সংবাদপত্র বিষয়ক আইন বইয়ের রচয়িতা।