বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১৮ অপরাহ্ন

বাংলাদেশে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য থাকছে না

Reporter Name / ১১৪ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

বার্তা ডেক্সঃ

রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভাস্কর্য নির্মাণের কার্যক্রম বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রকল্পের মূল নকশা পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনী উঁচানো ব্রোঞ্জের তৈরি ভাস্কর্যসহ অন্যান্য ভাস্কর্য বাদ দিয়ে এর জায়গায় ইতিহাসভিত্তিক স্মৃতিফলক তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্মৃতিফলকের পরিচিতিমূলক লেখাও নতুন করে ঠিক করা হচ্ছে।১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে জায়গায় ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে নির্মিতব্য ইন্দিরা মঞ্চ তৈরির কার্যক্রমও প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সরকারের চার উপদেষ্টার মতামতের ভিত্তিতে সম্প্রতি এই নকশা চূড়ান্ত করা হয়।গত ডিসেম্বরে এ প্রকল্প এলাকায় থাকা শাহবাগ থানাসহ অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য চার উপদেষ্টাকে নিয়ে পরিদর্শন কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির সদস্যরা হলেন– মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক, পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চির অম্লান করে রাখার লক্ষ্যে ২০১৮ সালে তৃতীয় দফায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এ বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে এবার ব্যয় না বাড়িয়ে প্রকল্পের মূল নকশা পরিবর্তন করে এটি বাস্তবায়নের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে।

দেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বাঙালির জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে এ নামকরণ করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ঘোষণা দিয়েছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের। একইভাবে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মাণ করা হয় ‘শিখা চিরন্তন’। প্রকল্পের দুটি পর্যায়ে ১৯৯৮ সাল থেকে এই উদ্যানে গ্লাস টাওয়ার, স্বাধীনতা জাদুঘর, ফোয়ারা, জলাধার ও উন্মুক্ত মঞ্চ ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের এ কাজে খরচ হয়েছে ২৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

২০০৯ সালের ৮ জুলাই স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, বধ্যভূমিসহ সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেওয়া ভাষণের স্থান সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়।পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নেওয়ার স্থান এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের স্থান সংরক্ষণের জন্যও বলা হয়েছিল। ওই রায়ের আলোকে ২০১৮ সালে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ জন্য শিশু পার্ক ভেঙে নতুন করে সাজানোর কার্যক্রম শুরু হয়।

প্রকল্প বাস্তবায়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জায়গায় নির্মিত শাহবাগ থানা স্থানান্তরের পাশাপাশি শিশু পার্কও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সমন্বয় করে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে শিশু পার্ক পুনর্নির্মাণের কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রায় ৬০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালের জুন মাসে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রকল্প বাস্তবায়ন থমকে যায়। কয়েক মাস প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত থাকার পর এবার নকশা পরিবর্তন করে এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৩৯৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে ভূগর্ভস্থ কার পার্কিংয়ের কাজ ৯৮ শতাংশ, মসজিদের কাজ ৯৮ শতাংশ, ৭টি ফুড কিউস্কের কাজ ৯৬ শতাংশ, ওয়াকওয়ের কাজ ৮২ শতাংশ, ওয়াটার ফাউন্টেনের কাজ ৯৬ শতাংশ শেষ হয়েছে।

এ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, মঈনুল ইসলাম প্রকল্প বাস্তবায়নে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ টাকা বেশিতে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিয়েছেন। বিনিময়ে তিনি ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কমিশন নেন। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় নিযুক্ত প্রকল্প পরিচালকের পদও বিভিন্ন সময় শূন্য ছিল।

গত সপ্তাহে সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান এবং ইন্ধিরা গান্ধীর ভাষণস্থলে নির্মিতব্য মঞ্চে ৫ আগস্টের পর ভাঙচুর চালানো হয়। অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ থেমে থেমে চলছে।
মূল নকশায় শাহবাগ থানা স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত থাকলেও এবার করা সংশোধিত নকশায় এটি বহাল রাখা হয়েছে। জানা গেছে, ভাস্কর্য নির্মাণসহ প্রকল্পের অন্যান্য খাতের ব্যয় কমিয়ে সেই অর্থে শাহবাগ থানার ৬ তলা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব সমকালকে বলেন, ‘যা শুনছি, যা দেখছি–তা দুর্ভাগ্যজনক। ইতিহাসের প্রতিপক্ষ হওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব থাকে না। কারণ ইতিহাস কালের চিরন্তন সত্যে জেগে থাকে, কিছু স্মৃতি স্মারক ভাঙচুর বা বিনাশ করা যায় বটে; কিন্তু তা আবারও পূর্ণ বিক্রমে ফিরে আসে। নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিতেই নিজের সত্যকে প্রতিরক্ষা দেওয়ার শক্তি থাকে ইতিহাসের।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সমকালকে বলেন, ‘ভাস্কর্যগুলো ভাঙচুর করা হয়েছে। আমরা ভাস্কর্যগুলো আর নির্মাণ করছি না। আমাদের মনে হয়েছে, এটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তবে সেখানে স্মৃতিফলক থাকবে এবং ইতিহাসের ঘটনাগুলো লেখা হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
এক ক্লিকে বিভাগের খবর

You cannot copy content of this page

You cannot copy content of this page